-বদরুল ইসলাম বাদল

সামরিক সরকার বিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদ দৌলত খান একটি অবিস্মরণীয় নাম। ।স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কক্সবাজার জেলার একমাত্র শহীদ।তিনি 1987 সালের 5 ডিসেম্বর পুলিশের গুলিতে চকরিয়া উপজেলার রাজপথে শাহাদাত বরণ করেন ।দৌলত খান সহ অনেক শহীদের আত্মত্যাগ তত্কালীন স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গনতন্ত্রকামী মানুষের আন্দোলনকে বেগবান করেছিল। যিনি চকরিয়া উপজেলাধীন কোনাখালী ইউনিয়নে নিজ গ্রামে চির ঘুমে শায়িত আছেন। শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা প্রিয় সহযোদ্ধা শহীদ দৌলত খান।

“একদফা এক দাবি” “সামরিক স্বৈরাচার, ধ্বংস হোক, নিপাত যাক”। ” শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না”।এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র জনতার ঐক্যবদ্ধ মিশিলের শ্লোগান। দৌলত সহ এরকম শ্লোগানের সাথে থেকে চকরিয়ার রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন দিন দিন বেগবান হয়। কিন্তু কে জানতো দৌলত খান নিজেই একদিন মিশিলের শ্লোগান হয়ে উঠবে। পাঁচই ডিসেম্বর 1987 নিজের তাজা রক্ত ঢেলে নিজে শ্লোগান হয়ে উঠলো দৌলত খান।চকরিয়ার রাজপথ দৌলতের রক্তে রঞ্জিত হল।সারা বাংলার রাজপথে উচ্চারিত হল “রক্তে লেখা আরেক নাম, বিপ্লবী দৌলত খান”।”দৌলতের রক্ত বৃথা যেতে পারে না”। “শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না”।রক্ত বৃথা যায় নাই। নব্বইয়ের গনআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতন হয়। কিন্তু যে সপ্ন নিয়ে আত্মবলিদান করেছিল দৌলত সহ সকল শহীদানের সপ্নগুলো রয়ে গেছে অধরা। ভুলে গেছি, ভুলে যাচ্ছি তাদের আত্মদানের কথা।রাজনীতির মারপ্যাঁচে হাবুডুবু খাচ্ছে তাদের আত্মবলিদান। শুধু দিবস ঘিরে কিছু রাজনৈতিক কথা বলাবলি হয়।হয়তো বা কারো মনে ও থাকে না।বর্তমান রাজনৈতিক নেতারা মনে রাখতে ও চায় না।।কক্সবাজারের পাবলিক হলের মাঠ শহীদ দৌলত ময়দান নামকরণ করা হয়েছে ।রাজনৈতিক দলের মিটিং সহ কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে শহীদ দৌলত নামটি উচ্চারিত হয়। শুধু তাই।সাধারণ জনসাধারণের দৃষ্টিগোচরে আসার জন্য নাম ফলকটি ও নাই।ফলে পর্যটন নগরে আসা পর্যটকরা বঞ্চিত হচ্ছে দৌলতের আত্মদানের ইতিহাস।গনতন্ত্রের জন্য কক্সবাজারের গৌরবের বীরত্ব গাঁথা সংগ্রামের কাহিনী ।গত বছর এই সময়ে আমার একটি লেখায় “শহীদ দৌলত ময়দানের” নামফলক লাগানোর আহ্বান করেছিলাম সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে। কিন্তু এখনো “শহীদ দৌলত ময়দান ” নামীয় কোন নামফলক চোখে পড়ে না। দৌলত খান আমাদের গর্ব,চেতনার নাম। আন্দোলন আর আত্মত্যাগের অনন্য উদাহরণ। কিন্তু আজকের দিনে দেখতে পাওয়া যায় মিটিং মিশিলে কিংবা জনসভায় শহীদ দৌলত খানের নাম টি ও স্মরণ করে না কেউ।দৌলত সহযোগীদের অভিমত, এভাবেই কি হারিয়ে যাবে দৌলত খানদের আত্মদান, বলিদান?
তাই শহীদ দৌলত স্মৃতি অমর রাখার জন্য “দৌলত ময়দানে” তার নাম ফলক লাগানোর আবেদন জানাচ্ছি বিজয়ের ডিসেম্বরের মধ্যে।আর শহীদ দৌলত খানের জন্মস্থান চকরিয়া উপজেলার কোনাখালী ইউনিয়নের নাম “শহীদ দৌলত নগর”করার দাবি জানাচ্ছি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম তাকে জানতে পারে।

শহীদ দৌলত খান ছিল একজন বন্ধুবত্সল, ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে ওঠা নির্লোভ সাহসী ও আপোষহীন ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মী। সংবিধান এবং গনতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে রাজপথে আন্দোলনের শহীদ। সাত দল, আট দল,পাঁচ দল সহ গনতন্ত্রকামী মানুষ দাবি আদায়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন।আমরা যারা সেদিনের মিশিলে ছিলাম সবারই ছিল একই দাবী। একই শ্লোগান।সবাই সবার সাথে গলা মিলিয়ে শ্লোগানে মুখরিত ছিল।5 ডিসেম্বর 1987 সকালে সর্বদলীয় মিশিলের প্রস্তুতি কালে সকালের দিকে রাজপথ থেকে বিনা উস্কানিতে পুলিশ গ্রেফতার করে মুজিববাদী সংগঠনের জননেতা মাষ্টার আবুল হাসেম বি কম, আমিনুল রশীদ দুলাল,ইয়াহিয়া খান কুতুবী, শাহ আলম, খালেদুল ইসলাম। বি এন পি সমর্থিত মোহাম্মদ জকরিয়া,সেলিম রেজা,জিল্লুর রহমান ।তাই তাদের মুক্তির দাবীতে সবার কন্ঠে ছিল, “নেতাদের মুক্তি চাই, মুক্তি দাও, দিতে হবে”।
কন্ঠে ছিল, “হাসেম স্যারের মুক্তি চাই”
“দুলাল ভাইয়ের মুক্তি চাই”
“জকরিয়া ভাইয়ের মুক্তি চাই ”
“ইয়াহিয়া ভাইয়ের মুক্তি চাই”
“খালেদ ভাইয়ের মুক্তি চাই”, মুক্তি চাই, দিতে হবে। সেদিনের বন্দীদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে না যাবার প্রশ্নে অনড় ছাত্র জনতা।সেই দাবী নিয়ে সর্বজন শ্রদ্ধেয় জননেতা মরহুম এডভোকেট আমজাদ হোসেনের নেতৃত্বে রাজপথে নেমে আসে সাতদল, আট দল,পাঁচ দলের নেতা কর্মীরা।স্বৈরাচার বিরোধী শ্লোগানের সাথে চকরিয়ার আটক নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবী নিয়ে।
সে সময়ের ছাত্র নেতা সরওয়ার আলম ভাইয়ের অগ্রগামী শ্লোগানে শ্লোগান মিলিয়ে ছিল আন্দোলনকারী রাজপথের সর্বদলীয় সংগঠনের সবাই। শ্লোগান মিলিয়ে ছিল, ছাত্র নেতা লুত্ফুল কবির, জহিরুল ইসলাম, আয়ুব খান ,মহসিন বাবুল, আমি বদরুল ইসলাম বাদল, জয়নাল উদ্দিন জয়নাল, মানিক বৈরাগী সহ আট দলীয় সংগঠনের আবুল হাসেম, গিয়াস উদ্দিন সহ অারো।এদের শ্লোগানের সাথে শ্লোগান মিলিয়ে ছিল সবাই।ব্যাপক মিশিলে আসা ছাত্র জনতা।( আরও অনেকের নাম স্মরণে না আসার জন্য দুঃখিত এবং ক্ষমা প্রার্থী)।সাথে অনেক নেতা কর্মী।

আজ যখন দেখি রাজনীতিতে সকল দলের সে সময়ের ত্যাগী নিপীড়িত নেতারা অবহেলিত, পিছিয়ে এবং দলের মধ্যে কোনঠাসা হয়ে পড়ে আছে তখন রাজনীতির সাথে রাজনীতির মিল খুঁজে পেতে কষ্ট হয়।কঠিন সময়ের রাজনীতির হাল ধরা রাজনীতির মাঠের যোদ্ধারা আজ অচল পয়সার মতো। যা সুস্থ রাজনৈতিক ধারা বিকাশের পথে অশনি সংকেত । সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে দেশের উন্নয়ন,জনগণের সেবা করাই যদি রাজনীতির মুলতত্ব হয়ে থাকে, তবে নির্দ্ধিধায় বলা যায় রাজনৈতিক কর্মীরা দেশপ্রেমিক।যদি তাই হয়ে থাকে,তবে কর্মসূচির ভিন্নতা থাকার পরও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সব দলের ঐক্যবদ্ধ সম্প্রীতি গড়ে উঠা কি অস্বাভাবিক??
যেমন শহীদ দৌলত কে উদাহরণ হিসেবে দেখতে পারি।
সেদিনের মিশিলে ছিল সব দলের অংশ গ্রহণ। শহীদ দৌলতের কন্ঠে মুক্তির দাবী ছিল সেদিনের চকরিয়ার রাজপথ থেকে আটক সকলের।আর দাবী আদায়ের সেই মিশিলে গুলিতে রাজপথে মারা যান ছাত্র লীগের দৌলত খান। সর্বদলীয় মিশিলের দৌলত খান।পত্রিকার মাঝে ও খবর প্রকাশ ছিল সর্বদলীয় মিশিলে পুলিশের গুলিতে দৌলত খান নিহত হয়।তাই শহীদ দৌলত গনতন্ত্রমনা রাজনৈতিক দলের সকলের জন্য আত্মত্যাগ করে।

বর্তমান সময়ে রাজনৈতিক দ্বিধা বিভক্তির সংস্কৃতি দেশে চোখে পড়ার মত।এক দলের সাথে অন্যদলের যেন চর দখলের মত সম্পর্ক। যাহা দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও গনতন্ত্রের জন্য চরম হুমকি ।তাই শহীদ দৌলত খানের মত সর্বদলীয় মিশিলের শহীদ সহযোদ্ধাকে ঘিরে তাকে স্মরণ করার জন্য এক মঞ্চে আসতে পারলে একে অপরের সাথে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যেতে পারে। গনতন্ত্রকে শৃঙ্খল মুক্ত করতে দৌলত খানরা আত্মদান করে। কিন্তু গনতন্ত্র আজ অবধি প্রাতিষ্টানিক শক্ত ভিত তৈরি হয় নাই। তাই গনতন্ত্রে বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক দল সমূহের ঐক্য বদ্ধ ঐক্যমতে দৌলত খানদের সপ্ন আলোর মুখ দেখতে পারে।

কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে” দৈনিক কক্সবাজার”পত্রিকার সম্পাদক বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মুজিব কোটের নুরুল ইসলাম সাহেবের নাগরিক শোক সভায় উপস্থিত হওয়ার সুযোগ হয়ে ছিল আমার ।সে শোক সভায় কক্সবাজারের প্রতিনিধিত্ব শীল সকল দল এবং পেশার মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। আওয়ামী লীগ, বি এন পি জাসদ সহ শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সহ সবাই।স্মরণ সভায় সবার কন্ঠে রাজনীতিবিদদের ঐক্য নিয়ে হতাশা, সদ্ভাব, সম্প্রীতির বন্ধন নিয়ে উত্কন্ঠা প্রকাশ করে সবাই । তাই সকল দলের জেলার শীর্ষ নেতারা নুরুল ইসলাম সাহেবদের মত সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ নিয়ে এক সাথে এক মঞ্চে আসার চেষ্টা করার উপর গুরুত্বারোপ করেন। ফলে একে অন্যের সাথে দুরত্ব কমে যাবার আশা ব্যক্ত করেন সবাই। তেমনি ভাবে চকরিয়ার শহীদ দৌলত খানকে নিয়ে এক সাথে এক মঞ্চে বসা যেতে পারে বলে মন্তব্য অনেক সাবেক ছাত্র নেতৃবৃন্দ। তখন গনতন্ত্রমনা শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ধীরে ধীরে গনতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শক্ত ভিত রচিত হবার পথ প্রশস্ত হবে।
শহীদ দৌলত খানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
জয় বাংলা,, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক :কলামিস্ট, সাবেক ছাত্র নেতা।